ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

কোটিপতি বানানোর শত শত অ্যাপ

২০২৩ আগস্ট ২৬ ১২:৩১:৪১
কোটিপতি বানানোর শত শত অ্যাপ

অনুসন্ধানে বেশকিছু ওয়েবসাইট ও অ্যাপের খোঁজ মিলেছে যেখানে মাত্র ১০ দিনেই বিনিয়োগের টাকা দ্বিগুণ করে দেওয়ার অফার করছে। ‘মারফিন-ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ’ নামক এক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, মোট পাঁচটি বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যার মধ্যে প্রথম প্ল্যানে বিনিয়োগ করা যাবে সর্বোচ্চ ৩০০ ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩৩ হাজার টাকা। মাত্র ২৪ ঘণ্টা বা একদিনেই যেখানে ১৫ শতাংশ লাভ দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। এভাবে দ্বিতীয় পরিকল্পনায় দুই দিনে ৩০ শতাংশ লাভ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করা যাবে ৫০০ থেকে ১ হাজার ৪৯৯ ডলার। এভাবে সর্বশেষ বিশেষ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে বিনিয়োগ করা যাবে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলার। আর এখানে ১০ দিনেই মিলবে বিনিয়োগকৃত অর্থের সমপরিমাণ অর্থাৎ ১০০ শতাংশ লাভ। এখানেই শেষ নয়, যে এজেন্ট এমন বিনিয়োগ এনে দেবে তার জন্য রয়েছে ১০ শতাংশ কমিশন। ওয়েবসাইটটিতে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের।

মারফিন ছাড়াও বাজারে জাল বিস্তার করছে ‘মোবিক্রিপ’ নামক আরেক কোম্পানি। যাদের প্রস্তাব রয়েছে ২৫ মাসে বিনিয়োগকৃত অর্থ ২৫০ শতাংশ করে দেওয়ার। অর্থাৎ ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ আড়াই লাখ হয়ে যাবে এই সময়ে। এই কোম্পানিতেও কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারলে মিলবে ১০ শতাংশ কমিশন। আরও বেশি গ্রাহক আনতে পারলে মোটা অঙ্কের কমিশনের সঙ্গে পাওয়া যাবে বেশকিছু বোনাস। যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন, তাদের জন্য রয়েছে বেশকিছু পদবিও। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় পদবি ‘ইমপেরর’ হতে পারলে তাকে ৩ লাখ ডলার দিয়ে দুবাইয়ে বাড়ি কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়েছে ওয়েবসাইটটিতে। ‘ফিনটচ’ নামক আরেক অ্যাপের প্রস্তাব প্রতিদিনের। তাদের কাছে কেউ ১ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন মিলবে কমপক্ষে ১৪ ডলার বা ১ হাজার ৬০০ টাকা। এখানেও কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারলে রয়েছে মোটা অঙ্কের কমিশন। এই কোম্পানির আবার রয়েছে নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি।

অন্যদিকে ২০ ডলার বিনিয়োগ করলে দৈনিক ৩৩ সেন্ট করে দেবে ট্রেস্ট এনটিএফই নামের আরেক প্রতিষ্ঠান। তবে ১০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে দিনে পাওয়া ১০০ ডলার। অন্য কারও কাছ থেকে বিনিয়োগ আনতে পারলে পাওয়া যাবে ১০ শতাংশ কমিশন। সেইসঙ্গে আছে জেনারেশন বোনাস, যা মূলত গতানুগতিক এমএলএম ব্যবসার ডান হাত-বাঁ হাত পদ্ধতি। এই প্ল্যাটফর্মে ডলারের জন্য টাকা জমা দেওয়া যায়। আর লাভের অর্থ উত্তোলন করা যাবে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে, এজেন্টদের হাতে ক্যাশে অথবা ফাইন্যান্সের মাধ্যমে বিটকয়েনে। ওয়েলাই ডট কম নামে আরেক প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করতে হয় কমপক্ষে ১০১ ডলার। তাহলেই উপহার পাওয়া যাবে ১৮ ডলার। নতুন বিনিয়োগকারী যুক্ত করতে পারলে পাওয়া যাবে ১০ শতাংশ কমিশন।

রেয়ানা মেটা এফএক্স-এ বিনিয়োগ করতে হবে ন্যূনতম ৫০ ডলার। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এই প্ল্যাটফর্মে ট্রেড হয় বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। রোবট সব কাজ করে তাই মুনাফার শতভাগ গ্যারান্টি দেয় রেয়ানা। কাউকে বিনিয়োগের জন্য নিয়ে এলে দেওয়া হয় ৫ শতাংশ কমিশন। প্রতিদিন বাংলাদেশ সময় রাত ১২টার মধ্যেই ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্টে লাভের অর্থ চলে যায় বলে দাবি প্ল্যাটফর্মটির।

হিলটন মেটা এফএক্স-এ ১০ ডলার দিয়ে খোলা যাবে অ্যাকাউন্ট আর ১০০ ডলার বিনিয়োগ করলে পাওয়া যাবে ‘র‌্যাঙ্ক’। কেউ নতুন বিনিয়োগকারী আনতে পারলে তিনি সেই বিনিয়োগের ১০ শতাংশ পাবেন। আর ট্রেডিংয়ের মুনাফা থেকে পাওয়া যাবে আরও ১ থেকে ৫ শতাংশ। অ্যাকাউন্টে ১০ ডলার থাকলেই উত্তোলন করা যাবে টাকা।

‘প্রাইম ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ’ নামক এক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, মোট পাঁচটি বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যার মধ্যে প্রথম প্ল্যানে বিনিয়োগ করা যাবে সর্বোচ্চ ৫৮০০ ডলার। মাত্র ২৪ ঘণ্টা বা একদিনেই যেখানে ১৮ শতাংশ লাভ দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। এভাবে দ্বিতীয় পরিকল্পনায় দুই দিনে ৪০ শতাংশ লাভ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করা যাবে ১০ হাজার ডলার। এভাবে সর্বশেষ বিশেষ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বিনিয়োগ করা যাবে আনলিমিটেড। আর এখানে ১০ দিনেই মিলবে বিনিয়োগকৃত অর্থের সমপরিমাণ অর্থাৎ ১৭৬ শতাংশ লাভ। এখানেই শেষ নয়, যে এজেন্ট এমন বিনিয়োগ এনে দেবে তার জন্য রয়েছে ১০ শতাংশ কমিশন। ওয়েবসাইটটিতে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার। পাত্তি আর্নাড নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ হয় এই প্রতিবেদকের। সেখান থেকে প্রতিবেদক যুক্ত হন প্রাইম ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের গোপন হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে। সেই গ্রুপ থেকে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করলে অস্ট্রেলিয়াতে মিলবে গাড়ি এবং বাড়ি। কারও মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি নতুন বিনিয়োগকারী আনতে পারলেও দুবাইয়ে মিলবে বাড়ি ও গাড়ি। এ ছাড়া প্লাটিন কয়েন, প্লাটিন আই-এক্স, ক্রাউড ওয়ান, আলটিমা টোকেন, ফিউচার ক্যাপিটাল এফএক্স, ওয়েলাই ডট কম, ইসি ব্রিলিয়ান্ট, টিআরসহ নামে-বেনামে বাজারে অফার ছড়াচ্ছে শত শত অ্যাপ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এমটিএফই অ্যাপ উধাওয়ের খবরের মধ্যেই গত ১৭-১৯ আগস্ট জিটিসি-এক্সের বাংলাদেশ টিমের কয়েকজন ট্যুর করেছে কক্সবাজারে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমটিএফই প্রতারণার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্যতম মূলহোতা নুরুন্নবী। নুরুন্নবী ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রয়-বিক্রয়সহ মানি লন্ডারিং ও অনলাইন প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে নুরুন্নবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া হিলটন মেটা এফএক্স : ‘হিলটন মেটা এফএক্স’-এর পেছনের মূল কারিগর কুমিল্লার মোহাম্মদ ইলিয়াস। হিলটনের আগেও মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম কারসাজিতে ইলিয়াসের ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। তবে ইলিয়াস নিজে বেশিরভাগ সময় মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। প্রথমে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের হিলটনে যুক্ত করান। তারপর তাদের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক বিস্তার করেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দেশে অবৈধভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ যে হারে বাড়ছে তাতে বহু মানুষ নিঃস্ব হওয়ার শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। একের পর এক এমন কারসাজিকে অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘মাথায় রাখতে হবে, যারাই অতিরিক্ত লাভের কথা বলছে, তারাই প্রতারণা করতে পারে। যেখানে দেশের বড় বড় ব্যাংক পারছে না ৭-৮ শতাংশের বেশি লাভ দিতে, সেখানে তারা কীভাবে শতভাগ লাভ দেবে?’ অ্যাপের ফাঁদকে অভিনব বলে উল্লেখ করে তিনি তরুণদের আরও সাবধানি হওয়ার পরামর্শ দেন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, প্রতারণার ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে কাজ শুরু করেছে সিআইডি। সংস্থাটির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউ কাজ শুরু করেছে। অবৈধ হুন্ডি রুখতে এরইমধ্যে তারা ১৮ হাজার ৭২৫টি এমএফএস অ্যাকাউন্ট ব্লক করেছে। ব্যবস্থা নিয়েছে ৫ হাজার ৮৮৪ এজেন্ট ও ২৩ ডিস্ট্রিবিউটরের বিরুদ্ধে। এর বাইরে অনলাইনে জুয়া পরিচালনার কারণে ৬৬৮টি ওয়েবসাইট, ১৪৮টি অ্যাপ ও ৪০১টি সোশ্যাল মিডিয়া পেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সংস্থাটি।’ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘এমটিএফই মূলত ফাইন্যান্স ব্যবহার করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নামে কোনো লেনদেন ছিল না। এ ধরনের এমএলএম বা বেটিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী সাইটগুলো নিয়মিত তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে দেওয়া হচ্ছে। বিটিআরসির সহযোগিতায় এরইমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। এরপরও সাধারণ মানুষ লোভে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, কখন কোনো সাইট প্রতারণা করবে, তা তো বোঝা যায় না। কেউ অভিযোগ করলে তখন খতিয়ে দেখে সাইট বা লিংকগুলো বন্ধ করা হয়। এই প্রতারকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইনে, অ্যাপসের মাধ্যমে হাজারো উপায়ে জনগণকে ধোঁকা দেয়। দুটি লিংক বন্ধ করলে এরা চারটি লিংক চালু করে। সবার আগে নিজেকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর।

মার্কেট আওয়ার/তারিকুল

ট্যাগ:

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর