ঢাকা, সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২

রাজউকে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের হাতে আটকে থাকছে ফাইল

২০২৩ আগস্ট ০২ ১২:৫০:২৩
রাজউকে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের হাতে আটকে থাকছে ফাইল

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছাড়পত্র-নকশা অনুমোদনের জন্য ফি’র অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হন সেবাগ্রহীতারা। এসব অর্থের সিংহভাগই দালালের মাধ্যমে যায় কর্মকর্তাদের হাতে। রাজউকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, দালাল ও সেবাগ্রহীতার মধ্যে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে নিয়মবহির্ভূত অর্থ নেওয়া হয়। আর অর্থ দিতে ব্যর্থ হলেই সেবাগ্রহীতাকে অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস।

অনিয়ম আর অর্থ হাতিয়ে নেওয়ায় ঘটনা বেশি ঘটে রাজউকের কানুনগো, সার্ভেয়ার ও রেখাকারের মাধ্যমে। বড় কর্মকর্তার তাগিদ থাকলেও তারা পেরে উঠছেন না ছোট কর্তার কারণে। আবেদন জমা হলেই নানাভাবে ভুল ধরিয়ে অর্থ আদায়ের নকশা আঁটেন তারা। এভাবেই প্রতিনিয়ত সাধারণ সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ বিষয়ে একাধিক সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা হলে এ ক্ষোভপ্রকাশ করেন। তাদের দাবি, বনশ্রী, সবুজবাগ ও বাসাবো এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় এ অনিয়ম বেশি হয়।

সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে অধিকাংশই আবাসন কোম্পানির মালিক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জমির মালিক। তাদের দাবি, কোনো প্রকল্প দ্রুত শেষ হলে সরকার সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পায়, দেরি হলেই রাজস্ব হারায়। এ অনিয়ম বন্ধ হলে সরকারের রাজস্ব যেমন বাড়বে, তেমনি আবাসন সংকট দূর হবে।

এ বিষয়ে রাজউক বলছে, এখন থেকে পাঁচদিনের বেশি ফাইল ধরে রাখতে পারবেন না কোনো কর্মকর্তা। এই সময়ের মধ্যে সমাধান না হলে অন্য কর্মকর্তার কাছে চলে যাবে ফাইল। মনিটরিং করা হবে। এরপরও যদি কারও কোনো অভিযোগ থাকে, তা মৌখিক বা লিখিত হলেও তদন্ত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, দালালদের দৌরাত্ম্য বেশি রাজউকে। দালালদের বেশিরভাগ রাজউকের কর্মচারী, রয়েছে বহিরাগতরাও। কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এমন অনিয়ম করেন তারা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে এ অনিয়ম বেশি হয়। তারাই মূলত অর্থের লেনদেন করেন। বিশেষ করে আবেদনে ভুল রয়েছে এমন অজুহাতে সেবাগ্রহীতাকে অনুমোদনের নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য করেন তারা।

কথা হয় ফয়সাল নামে এক ভুক্তভোগীর সঙ্গে। একটি আবাসন কোম্পানির কর্মকর্তা ফয়সাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজউকে ফাইল জমা হলেও মাসের পর মাস সময় নেন নিচের লেবেলের (দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি) কর্মকর্তারা। কোনো ভুল না থাকলেও অর্থের জন্য ভুল ধরার চেষ্টা করেন তারা। এটি বেশি হয় অঞ্চল-৬ এ। সেখানের কানুনগো, সার্ভেয়ার ও রেখাকার পর্যায়ে এ সমস্যা বেশি হয়।’

একই সমস্যায় পড়েছেন একাধিক ব্যক্তি ও আবাসন ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে কথা হয় অঞ্চল-৬ এর কানুনগো আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আপনি যেটা জানেন সেটা তো আমিও জানি, এখানে মধ্যবর্তী কিছু নেই। রাজউকে কি চলে না চলে সেটা বইতে স্পষ্ট করা আছে। এখানে কারও নাম বললে হবে না, কে কী জন্য বলে সেটা তার বিষয়।’

অঞ্চল-৬ এ বেশি দিন ফাইল জমা থাকে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অঞ্চল-৬ এ আগের ফাইল জমা ছিল, আবার মধ্যে সার্ভার হ্যাক হওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। সেই হিসেবে লোডটা একটু বেশি, তবে নতুন ফাইলতো খুব একটা আটকে থাকে না। নিয়ম মতোই হচ্ছে, পরিকল্পনা স্যারের নির্দেশে।’

রাজউকের সেবাগ্রহীতারা জানান, নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে নাগরিক সনদ ও বিধিমালায় ছাড়পত্র অনুমোদনের সময় যথাক্রমে ১৫ দিন ও ৩০ দিন। তবে, এক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাকে নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য করা হয়। সুনির্দিষ্ট হারে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়া না হলে নকশা অনুমোদন হয় না এসময়ের মধ্যে। এজন্য মাসের পর মাস পড়ে থাকে ফাইল। এক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে এক লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থের লেনদেন হয়।

তারা আরও জানান, রাজউকের ছাড়পত্র অনুমোদনে নানাভাবে সময়ক্ষেপণ করা হয়। জনবল ঘাটতি আর কাগজ পরীক্ষার কথা বলে আটকে রাখা হয় ফাইল। এর মধ্যে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিলেই মেলে অনুমোদন।

এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজউকে ফাইল কেন দিনের পর দিন পড়ে থাকবে, এ বিষয়ে আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি- বড় কর্মকর্তাদের আগ্রহ আছে, দ্রুত ফাইল ছেড়ে দেওয়ায়। কিন্তু নিচের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এটা নিয়ে গড়িমসি করেন। তারা খুঁটে খুঁটে ভুল ধরায় ব্যস্ত থাকেন। অর্থ ছাড়া তাদের কাছে ফাইল নড়ে না, এমন অভিযোগ একাধিক এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘কোনো প্রকল্প রেডি হলেই সরকারের রাজস্ব আসে। প্রকল্প পড়ে থাকলে রাজস্ব আদায় হয় না। আমাদের দাবি, কোনো ফাইল যেন পড়ে না থাকে। সবাই যেন সমানভাবে সেবা পায় রাজউক থেকে। এতে আবাসন সংকট দূর হবে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে এ খাত।’

নানা অভিযোগ-আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অনলাইনে আবেদন হলে কোনো সমস্যা আছে কি না সেটা নিচের লেবেল থেকে কোয়ারি করা হয়। এটাও ঠিক যে, মানুষকে হয়রারি করা হয়, তবে মানুষ ৫ থেকে ১০ শতাংশ হতে পারে। তবে ৯০ শতাংশ কোয়ারি সঠিক হয়। এজন্য আমরা একটা নীতিমালা করেছি, কোন কর্মকর্তার কাছে কতদিন ফাইল পড়ে থাকছে। একজন ইন্সপেক্টর সর্বোচ্চ পাঁচদিন ফাইল ধরে রাখতে পারবেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত না দিতে পারলে অটোমেটিকভাবে পরবর্তী কর্মকর্তার কাছে যাবে ফাইল। তিনিও সমাধান না দিতে পারলে এর উপরের কর্মকর্তার কাছে যাবে। যাতে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়।’

তিনি বলেন, ‘একজনের কাছে দীর্ঘদিন ফেলে না রেখে অন্য জনের কাছে যাবে ফাইল। একটি প্ল্যান পাস করতে ৪৫ দিন লাগে, ছাড়পত্র নিতে ৩০ দিন। এটা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এরই মধ্যে রাজউক চেয়ারম্যান এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে এ নিয়ে একটা অর্ডার হবে। এরপরও যদি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী দেরি করে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে (মৌখিক বা লিখিত) ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মার্কেট আওয়ার/তারিকুল

ট্যাগ:

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর