ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২

আদানির বিদ্যুৎ ও ঢাকা সফর: এত রাখঢাক কেন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের

২০২৩ জুলাই ১৬ ২২:৪৫:২৬
আদানির বিদ্যুৎ ও ঢাকা সফর: এত রাখঢাক কেন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের

এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু সবকিছুতেই চলছে লুকোচুরি। সর্বশেষ আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান গৌতম আদানির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়েও ছিল রাকঢাক।

সরকার এবং আদানির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ কেনা শুরু করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিতে গৌতম আদানি ঢাকা সফর করেছেন।

গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় বাংলাদেশে এসে দুপুর ১টায় বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া গৌতম আদানির এই তিন ঘণ্টার সফর নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় রক্ষা করা হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ গৌতম আদানির ব্যক্তিগত বিমানে উড়ে এসে এই ঝটিকা সফর প্রকাশ পায় গতকাল বেলা ১টা ৪০ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড টুইটার হ্যান্ডলে তাঁর করা এক টুইটে। মূলত এরপরই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এর আগে তাঁর সাক্ষাতের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি কোনো পক্ষই।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি আছে। একই সঙ্গে আছে স্বচ্ছতার অভাব। এ জন্য আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় ঘটনা যেমন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু এবং আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান গৌতম আদানির বাংলাদেশ সফর নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে আছে সরকারি লোকজন।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নজর রাখা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে মারাত্মক স্বচ্ছতার অভাব আছে। না থাকলে কেন সরকার সবকিছু গোপন করতে চাইবে। বাংলাদেশের জন্য বানানো বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে, সেটা আমাদের জানতে হয় ভারতের সংবাদমাধ্যম মারফত। এটা তো সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার কথা। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যা হচ্ছে এটা খুবই দুঃখজনক। যদি লুকানোর কোনো কিছুই না থাকে তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে এগুলো ফলাও করে বলা উচিত।’

ড. ইজাজ হোসেন আরো বলেন, ‘আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রর বাণিজ্যিক উৎপাদনের শুরু হয়ে গেল, তবুও আমরা এখনো জানি না প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য কী পরিমাণ টাকা দিতে হচ্ছে। যেহেতু বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে, একই সঙ্গে এখন দিতে হবে ক্যাপাসিটি পেমেন্টও। বছরে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট কত দিতে হবে সেটাও স্পষ্ট না।’

চলতি বছরের ৬ এপ্রিল অনেকটা নীরবেই আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৮০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর খবর প্রকাশ পায় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জকে লেখা আদানির একটি চিঠির সূত্রে। তখন বিদ্যুৎ বিভাগ প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর বিষয়টি অস্বীকার করেছিল।

একই ঘটনা ৮০০ মেগাওয়াটের দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর ব্যাপারেও ঘটেছে। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জকে লেখা চিঠিতে আদানি গ্রুপ দাবি করে, গত ২৫ জুন রাত ১২টায় বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা হয়েছে। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে আদানির দেওয়া চিঠি ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেলে বিদ্যুৎ বিভাগ দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর কথা স্বীকার করে।

দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার খবরে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ আদানির শেয়ারের দাম বেড়ে যায় ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ম তামিম বলেন, ‘এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে এখন বেশ কিছু কারিগরি সমস্যা দেখা দিচ্ছে, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার আগে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা দরকার ছিল সেগুলো করা হয়নি। যার জন্য দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রায় কোনো না কোনো ইউনিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারিগরি ত্রুটির কারণে। সরকারের তরফে এ নিয়ে একটা অস্বস্তি আছে। এ জন্য আমরা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে বেশ লুকোচুরি দেখতে পাচ্ছি।’

ম তামিম আরো বলেন, ‘আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারফরমেন্স টেস্টিং এবং হস্তান্তর প্রক্রিয়ার কোনো চিত্র কোনো পক্ষ থেকেই আমাদের সামনে দেওয়া হচ্ছে না। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যে বিভিন্ন সমস্যা আছে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু নিয়ে লুকোচুরির কোনো কারণ আমি দেখি না। কিন্তু এরপরও কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসা বিদ্যুৎ সরকারের পক্ষ থেকে কেনে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এত কিছু হয়ে গেল কিন্তু পিডিবির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কোনো বিবৃতি আসেনি।

১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিতে ঝটিকা সফর করে গেলেন আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। এমনটাই জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

প্রতিমন্ত্রীর দাবি, গৌতম আদানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন অনেক দিন ধরেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সময় করতে পারছিলেন না ।তিনিই এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে এই সাক্ষাতের সময় প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান বা বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল ১০টায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গৌতম আদানি ব্যক্তিগত বিমানটি অবতরণ করে। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যান ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জানা যায়, প্রায় আধা ঘণ্টা গৌতম আদানি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অবস্থান করেন। বেলা ১১টার পর বিমানবন্দরের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ত্যাগ করেন গৌতম আদানি।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট মতো বিদ্যুৎ নিচ্ছি।’

তবে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেছে, দুই দিন ধরে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৬০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি বিদ্যুৎ আমদানি করছে। মাঝখানে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কয়েক ঘণ্টা ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছিল। যদিও বর্তমানে উৎপাদনে থাকা গোড্ডায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের সক্ষমতা মোট ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট।

আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ ১২ ঘণ্টা বন্ধ ছিল গত দুই দিনেআদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ ১২ ঘণ্টা বন্ধ ছিল গত দুই দিনেআদানি থেকে কম দামে, টেকসই ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে— এ কথা বলে সরকার ২০১৭ সালে আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুসারে, আদানি গ্রুপের কোম্পানি আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি।

তবে উৎপাদন শুরুর আগেই এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লার দাম বেশি দাবি করে আদানি গ্রুপ। কয়লার দাম নিয়ে পিডিবি আদানির সঙ্গে আলোচনা শুরু করলে আদানি প্রতিশ্রুতি দেয়, পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দামের চেয়ে তাদের কয়লার দাম বেশি হবে না।

জানা যায়, আদানি গ্রুপ এখন পর্যন্ত তিন মাসের বিল জমা দিয়েছে। তবে পিডিবি এখনো কোনো বিল পরিশোধ করেনি।

উল্লেখ্য, বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণার ফলে আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রথম পাঁচ বছর শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। এর পরবর্তী পাঁচ বছর তারা পাবে ৫০ শতাংশ শুল্ক ছাড়।

কিন্তু শুল্ক ছাড়ের বিষয়টি বাংলাদেশকে না জানায়নি আদানি। তারা কয়লার দাম দেশে অবস্থিত রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে প্রায় ২০০ ডলার বেশি নির্ধারণ করে তারা। আদানি গ্রুপ মার্চের শুরুর দিকে প্রতি টন কয়লার দাম ৪০০ ডলার নির্ধারণ করে বিপিডিবির কাছে চাহিদাপত্র পাঠায়। ওই সময় বিপিডিবি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনার দরপ্রস্তাব আহ্বান করে। তাতে প্রতি টনের দাম প্রস্তাব করা হয়েছিল ২৩২ ডলার।

কয়লার দাম পুনর্নির্ধারণ ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যে শুল্ক-করে ছাড় পাচ্ছে সেটির সুফল বিপিডিবি কেন পাবে না— তা নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশে। বিপিডিবির এক সূত্র জানিয়েছে, কয়লার দাম পুনর্নির্ধারণ ও শুল্ক–কর ছাড়ের বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

উল্লেখ্য, আদানি গ্রুপের গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আগামী ২৫ বছর ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ পাবে বাংলাদেশ।সূত্র: আজকের পত্রিকা

মার্কেট আওয়ার/মোর্শদ

ট্যাগ:

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর