ঢাকা, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে ঢুকে ক্ষমতার সঙ্গে বাড়ান ব্যবসা

২০২৩ ফেব্রুয়ারি ০৬ ০৯:২৮:৪৩
ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে ঢুকে ক্ষমতার সঙ্গে বাড়ান ব্যবসা

মূল প্রবন্ধে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র গবেষণা ফেলো মির্জা এম হাসান বলেন, বাংলাদেশে পুঁজিবাদ ও ব্যবসা বিকাশের ইতিহাস অনেকটা পরিবর্তিত। ব্যবসায়ীরা নানাভাবে এখানে বিকাশ লাভ করেছে। কখনো সেনা শাসনের আমলে, কখনো রাজনৈতিক সরকারের আমলে। একটা বিষয় এখানে মিল রয়েছে, সেটা হলো ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ঢুকেছে এবং তাদের ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাও বেড়েছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা প্রথমে অর্থায়ন করে, পরে নানা সহযোগিতার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলে প্রবেশ করে। পরে আবার তারাই সংসদ সদস্য হন।

রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনের শেষ দিনে বাংলাদেশে পুজিবাদের বিকাশ, উত্থান এবং প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা অংশ নেন। সানেমের এটি ষষ্ঠ আয়োজন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে। সে সময়েও পরিত্যক্ত সম্পত্তি লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে এই কাজের সূত্রপাত ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক সাহায্যের প্রকল্পগুলো যেগুলো দেশের জন্য প্রয়োজন ছিল না সেগুলো এনে সেখান থেকে পুঁজি বের করা হয়েছে। অতিমূল্যায়িত প্রকল্প থেকে অর্থ আহরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ট্রেড বডিগুলোর যে কমিটি হয় তা চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন হয়, নির্বাচন হয় না। রাজনৈতিক যে প্রক্রিয়ায় এটা হয় সেই দুর্বলতায় পুঁজিবাদ সৃষ্টি করে।

পুঁজিবাদ টেকসই হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পুঁজিবাদের যে অবস্থা তা রাষ্ট্রকে শোষণ না করে এগিয়ে যেতে পারবে কি না তা সন্দেহ রয়েছে। এ জায়গায় একটা পরিবর্তন আসছে। আগে দেখতাম বাজার পরিস্থিতি ব্যর্থ হচ্ছে, ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে, এখন দেখছি এলিট শ্রেণিরা ব্যর্থ হচ্ছে এবং এই সিস্টেমটাকে চালু রাখার পর একটা কর্তৃত্ববাদী সিস্টেম চলে আসে। এই কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা টেকসই হবে না। এটার ক্রান্তিকাল এরই মধ্যে চলে এসেছে। তিনি বলেন, পাঁচ বছর ধরে যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছিল সেগুলো করা হয়নি। অথচ এখন আইএমএফের শর্তের কারণে সেগুলো সংস্কার করা হচ্ছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত এক দশকে একটি উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। যাদের দেশ এবং বিশ্ব সম্পর্কে যথেষ্ঠ জ্ঞান আছে। কোথায় অন্যায় বা অবিচার হচ্ছে সেটা তারা দেখে। একই সঙ্গে আমাদের একটা বড় শিক্ষিত যুব সমাজ রয়েছে, যাদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। তাদের নিয়েই নতুন একটি সামাজিক শক্তি গড়ে উঠেছে। এই নতুন সামাজিক শক্তি দেশের প্রথাগত রাজনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে মাঠে এসেছে।

তিনি বলেন, এই সামাজিক শক্তি সাম্প্রতিককালে থাইল্যান্ড থেকে সুদান পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে পুঁজিবাদের উত্তরণের চর্চাকে বুঝতে হলে এই সামাজিক শক্তির নতুন উত্থান বা বিবর্তন বাংলাদেশেও হচ্ছে সেটা বুঝতে হবে। ভবিষ্যৎ সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ নতুন একটা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আরও নতুন পর্যায়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

উন্নয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অসামঞ্জস্যতা রয়েছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নত দেশের যে স্বপ্নের কথা বলা হচ্ছে সেই উন্নয়নের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়নের মডেল ছিল দৃশ্যমান, ২০টি মেগা প্রকল্পে যে টাকা দেওয়া হচ্ছে তার অর্ধেক টাকা দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে। এই যে অসামঞ্জস্যতা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে, বিশেষ করে যারা পিছিয়ে পড়া মানুষ আছে তাদের মধ্যে,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, দিন দিন ব্যবসায়ীরা সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাপ প্রয়োগ করে থাকে। সেটা অনেক সময় জনকল্যাণমূলক নাও হতে পারে। তিনি বলেন, অর্থ, পেশি শক্তি এবং কারসাজি পুঁজিবাদের অন্যতম শক্তি। কারসাজি করে ব্যবসায়ী, ব্যুরোক্রেট সবাই যখন অসৎ হবে তখন ভোট না হলেও ভোট হবে, টাকা আত্মসাৎ হবে আরও অনেক অসৎ কাজ হবে। এমন হলে বাংলাদেশ কোথায় যাবে যাবে সেটা একটা প্রশ্ন। তরুণদের প্রতিবাদ, আর বিদেশি পাওয়ার কোন দিকে যায় সেটাও প্রশ্ন।

বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাদীদের বাধার কারণে সরকার নিজেদের সম্পদ ব্যবহারের পরিবর্তে আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। একটা শক্তি দেশের ভেতরের গ্যাস উত্তলনের পরিবর্তে আমদানির দিকে প্রভাবিত করল। এখন গ্যাসের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সবকিছুর দাম বাড়াতে হলো।

তিনি বলেন, দেশে ডলার সংকট একদিনে হয়নি। ১০-১২ বছর ধরে ডলার রেট ৮০ টাকার আশপাশেই ছিল। অথচ মূল্যস্ফীতি ২-৩ গুণ বেড়েছে। অথচ ডলার রেট পরিবর্তন করা হয়নি। এটা পুঁজিবাদীদের বাধার কারণে সম্ভব হয়নি।

পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. আশিকুর রহমান বলেন, যেসব দেশে গণতন্ত্র দুর্বল সেসব দেশে পুঁজিবাদ প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলাদেশ এখনো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যে কারণে এখানে পুঁজিবাদ দুর্বল।

অর্থনীতিবিদ স্বপন আদনান বলেন, ব্যবসায়ীরা নিজেরাই রাজনীতিবিদ হয়ে গেছে। যে কারণে পুঁজিবাদ থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। পুঁজিবাদের কারণে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দুর্বল করা হয়েছে। যার ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নেই। পুঁজিবাদী সিস্টেম যে কোনো দেশের জন্য আশঙ্কাজনক।

সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জতীয় সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি তারাই মূলত এখন সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে যখন জাতীয় সংসদ গঠন করা হয় তখন ও ব্যবসায়ী ছিল; কিন্তু তা ২৪ থেকে ২৭ শতাংশ। কিন্তু দিন দিন সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিলো ৫৬ শতাংশ। এর ফলে তারা নিজেদের ব্যবসায়ী স্বার্থে নানা ধরনের আইন পাশ করে এবং নানাভাবে সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করে।

এএসএম/

ট্যাগ:

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর